শ্যামবাজার -হাসনাবাদ মার্টিন রেলপথ

 শ্যামবাজার -হাসনাবাদ মার্টিন রেলপথ :

আপনি যদি কলকাতার চিনার পার্ক হয়ে রাজারহাট রোড ধরে একটু ভিতরে এগিয়ে যান , তাহলে কিছুদূর পর 'রাজারহাট স্টেশন' বলে একটা বাসস্টপ পাবেন। আপনি যদি মনে করেন কাছাকাছি কোনো পুলিশ স্টেশন থাকার জন্য বাসস্টপের এইরকম নাম হয়েছে তাহলে ভুল করবেন। 

বাসস্টপের নাম হয়েছে ট্রেন স্টেশনের নামে। কিন্তু রাজারহাট বা তার আশেপাশের এলাকায় জখন কোনো ট্রেনলাইনই নেই তাহলে স্টেশন কি করে আসবে?

কিভাবে এই বাসস্টপ বা এলাকার অদ্ভুত নামকরণ হলো ?

এই রহস্যের উদঘাটন করা যাক। ইতিহাসের পাতা উল্টে পিছিয়ে যাই প্রায় ১১৩ বছর আগে। 

স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জি ছিলেন সেইসময় 'মার্টিন বার্ন' কোম্পানির অধিকর্তা। তুখোড় ব্যাবসায়িক বুদ্ধিধারী এই বাঙালি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতের রাজধানী কলকাতায় বিভিন্ন কর্মসূত্রে প্রচুর মানুষ সন্নিহিত জেলাগুলি থেকে নিত্য যাতায়াত করেন।অথচ যোযাযোগ ব্যবস্থা খুব করুণ । শিল্পোন্নত হাওড়ার গ্রামাঞ্চল এবং কৃষিন্নত 'চব্বিশ পরগনার' মধ্যে মার্টিন কোম্পানি যদি স্বতন্ত্র রেলপথ তৈরি করে, তাহলে প্রচুর মানুষ তার সদ্ব্যাবহার করবে। এতে কোম্পানির আয় বাড়বে। তারই পরিকল্পনায় একে একে তৈরি হতে থাকে মার্টিন কোম্পানির ন্যারো গেজ রেলপথ। ন্যারো গেজ মানে দুইটি লাইনের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ২ফুট ৬ইঞ্চি। প্রথমেই তৈরি হয় হাওড়া -আমতা এবং হাওড়া -শেয়াখলা রেলপথ। 

সালটা ১৯০৫।বাঙালির কাছে কুখ্যাত হয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের জন্য। ঠিক এই বছরেই খুলে দেওয়া হয় শ্যামবাজার-হাসনাবাদ মার্টিন রেল। লোকের মুখে মুখে এই ট্রেন মার্টিন গাড়ি বা ছোটগাড়ি বলে পরিচিতি পায়। পুরো উত্তর এবং পূর্ব কলকাতার বুক চিরে চলে যেত এই ট্রেন।ছাড়তো বেলগাছিয়ায় বর্তমানে যেখানে ট্রাম ডিপো সেখান থেকে। যদিও স্টেশনের নাম ছিল শ্যামবাজার। এরপর পাতিপুকুর , কেষ্টপুর বাগুইআটি , রাজারহাট, লাঙ্গলপোতা , বেলিঘাটা হয়ে চলে যেত বসিরহাটের দিকে। এই প্রত্যেকটি জায়গায় ছিল স্টেশন। 

এরপরে এই ট্রেন ক্রমশ কার্তিকপুর, দেগঙ্গা , বেড়াচাঁপা ,ধান্যকুড়িয়া ,খোলাপোতা ,বসিরহাট হয়ে পৌঁছতো হাসনাবাদ। উল্টোদিক থেকে একটা ট্রেন একইভাবে এই দিকে আসতো। পুরো পথ অতিক্রম করতে লেগে যেত প্রায় গোটা একটা দিন। আজকের লোকাল ট্রেনের যুগে যা ভাবাই যায় না। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কারুর বাগান বা কারুর উঠোনের মধ্যে দিয়ে মাত্র ছয় কামরার এই ট্রেন এগিয়ে যেত। বড় রোমান্টিক ছিল সেই দৃশ্য। 

কিন্তু সেই সুখের দিন আর রোমান্টিকতা বেশি দিন রইলো না। ইতিমধ্যে চালু হয়ে গিয়েছিলো শ্যামবাজার থেকে বসিরহাট বাস পরিষেবা। দুলকি চলে চলা মার্টিন রেলের থেকে অনেক কম সময় যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতো। সময়ের সাথে বাড়তে লাগলো খরচ এবং বিনা টিকেটের যাত্রী। গতি কম হওয়ায় খুব সহজেই বিনা টিকেটের যাত্রীরা উঠে পড়তে লাগলো।এমনকি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও টেনিদা আর তার সঙ্গীদের ''বনভোজনের ব্যাপার'' গল্পে বিনা টিকেটে এই ট্রেনে চড়িয়েছিলেন। যাইহোক লোকসানের বোঝা বিশাল বেড়ে গেলে ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

চালু হওয়ার মাত্র ৫০ বছর পর ১৯৫৫ সালে ১লা জুলাই শেষ ট্রেনটি শ্যামবাজার থেকে ছাড়ে। লাইনের দুপাড়ে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করেছিল। আপন বিচ্ছেদের মতো করুন চিত্তে লোকে দেখলো ট্রেনের অন্তিম যাত্রা। ট্রেনের শেষ কামরায় কেউ চক দিয়ে লিখে দিয়েছিলো ''শেষ ট্রেন''।

ক্রমে এই লাইনেটিকেই ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৯৬২ সালে খুলে দেওয়া হয় শিয়ালদাহ-হাসনাবাদ লাইন যা আজ কয়েক লক্ষ মানুষ ব্যবহার করেন। 

এই প্রসঙ্গে বলি যে রাজারহাটে যে জায়গায় মার্টিন রেলের স্স্টেশন ছিল তার নাম আজও রয়ে গেছে '' রাজারহাট স্টেশন''। এই ট্রেন হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু এলাকার লোকের অবচেতন মনে আজও রয়ে গেছে সেই স্টেশন আর রেলপথের কথা।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন